খেজুর গুড়ের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমের যশোর বিখ্যাত হলেও কম যায় না উত্তরের জেলা নাটোরও। জেলার আনাচে কানাচে দেখা মেলে প্রচুর সংখ্যক খেজুর আর তালগাছ। কিছু গ্রাম আবার বেশ নামকরা গুড়ের জন্য। এসব গ্রামে তৈরি গুড় পাইকারি হাট থেকে যায় ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। তেমনই একটি গ্রাম দেশের উষ্ণতম স্থানখ্যাত লালপুরের দুড়দুড়িয়া। মোটরবাইকে মেঠোপথ ধরে সকালে এগোতে এগোতে দেখা গাছি জিয়াদ আলীর সঙ্গে। গাছে নতুন কাট দিচ্ছেন তিনি। কিছু গাছ থেকে আবার রস মিলছে কয়েকদিন ধরে। সেগুলো দিয়ে চলছে গুড় তৈরি। পথে কথা হলো জিয়াদের সঙ্গে। তিনি জানান, এবার ৪০টির মতো গাছ কেটেছেন। রসও পাচ্ছেন নিয়মিত। এই সিজনে (চার মাস) এসব গাছ থেকে সব বাদ দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ থাকবে। তার সঙ্গে কথা শেষে একটু এগিয়ে দেখা গেলো, গুড় তৈরি করছেন রিয়াসাদ, জলিলসহ তার পরিবারের লোকজন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো পুরো গুড় তৈরির প্রক্রিয়া। তবে হতাশার কথা, যেসব গুড় তারা তৈরি করছেন তার অধিকাংশই চিনি মেশানো। খাঁটি গুড় চিনি মেশানো গুড় থেকে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। কিন্তু দেখতে ভালো হয় না। তারা জানান, দেখতে ভালো না হলে ক্রেতা নেয় না। তাই চিনি মিশিয়ে রং সাদাটে করে বিক্রি করেন হাটে। খাঁটি গুড় কেউ যদি অর্ডার করেন কেবল তখনই তৈরি করেন। সেই গুড়ের রং একটু কালচে’ হয়। আমরা যখন সেখানে হাজির তখন গুড়ের রং এসে গেছে চৌকো কড়াইয়ে। খোলা জায়গায় বড় কড়াইয়ে রস ঢেলে ঘণ্টাখানেক জ্বালানোর পর গুড়ের রং আসতে শুরু করে। রং এলে কিছুক্ষণ পর পর একটি খালি হাড়িতে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে তার মধ্যে গুড়ের তরল ফোঁটা ফেলা হয়। ফেলে দেখা হয় গুড়ের দানা আসছে কিনা। দানা এসে গেলে গুড় নামিয়ে ফেলা হয় বড় মাটির পাত্রে। এরপর চলে বীজগুড় তৈরি। এই বীজগুড় ব্যাপারটি বেশ অদ্ভুত। বীজগুড় ছাড়া কোনোভাবেই বসানো যায় না পাটালি। গুড় নামিয়ে ফেলে কড়াইয়ে লেগে থাকা গুড়ের স্তর ক্রমাগত ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে যখন লালচে সাদা হয়ে আসে এবং পাটালির মতো জমে যায় তখন সেগুলো এক জায়গায় করা হয়। এটাই পাটালির মূলমন্ত্র। বীজগুড় তৈরি হলে এবার পাটালি বসানোর পালা। পাটালির জন্য রয়েছে ছোট ছোট অর্ধগোলাকৃতির মাটির ছাঁচ। মাটিতে সারি ধরে সাজিয়ে উপর দিয়ে দেওয়া হয় ভেজা কাপড়। কাপড় দেওয়া হয়ে গেলে তরল গুড়ের মধ্যে দেওয়া হয় একমুষ্ঠি পরিমাণ বীজগুড়। দিয়ে ঘোটা হয় মিনিটখানেক। সঙ্গে সঙ্গে গুড়ের আসল রং এসে হাজির পাত্রে। ঘনও হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এবার পাটালির ছাঁচে বসানোর পালা। গুড় ঢেলে ছাঁচগুলো পূরণ করে ঘণ্টা দুয়েক রেখে দিলেই বসে হয়ে যাবে পাটালি। জলিল জানান, চল্লিশটি গাছ থেকে পাওয়া রসে একদিনে অন্তত ২০ থেকে ২৫ কেজি গুড় পাওয়া যায়। বিক্রি হয় প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এভাবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা গুড় বানান তারা। তবে একবাক্যে স্বীকার করলেন, অর্ডার ছাড়া অরিজিনাল গুড় বানান না। লালপুরের গোপালপুর বাজারে গিয়ে মিললো এ তথ্যের সত্যতা। সেখানে পাইকারি গুড়ের বড় বাজার। রয়েছে আড়তও। তবে আসল ভালো গুড় চেয়ে পাওয়া গেলো না কোথাও। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ভালো গুড় নিতে গেলে কিনতে হবে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজিপ্রতি। আর আগে না বললে সেটা দেওয়াও সম্ভব নয়। ভাবখানা এমন, চিনি মেশানো গুড়ে অভ্যস্ত ক্রেতা।
Category
😹
Fun